অর্থের চেয়ে বিশ্বাস বড়, দোকানি ছাড়াই চলছে দোকান !

1858

দোকানি ছাড়াই দোকান- মনে করুন আপনি হাঁটছেন এক সরু রাস্তা দিয়ে। এর দু’পাশে ঘন জঙ্গল। সেই রাস্তায় চলতে চলতে মাঝে মাঝেই আপনাকে থমকে দাঁড়াতে হবে। কারণ জনমানবহীন রাস্তার ধারে সুন্দর ভাবে সাজানো রয়েছে ছোট ছোট দোকান। কোনও দোকানে ফল-সব্জি রাখা, তো কোনওটায় ফুল, কোনটায় আবার আচার-সহ নানা খাদ্য দ্রব্য।

এখান থেকে আপনি পছন্দমত যে কোনো জিনিস নিতে পারবেন। তবে সেগুলোর দাম দেয়ার জন্যকোনো লোক পবেন না। নির্দিষ্ট বাক্সে টাকা রেখে চলে আসবেন পছন্দের জিনিস নিয়ে। সবগুলো পণ্যের গায়েই যে দাম লেখা রয়েছে! এভাবে দোকানি বা কোনো সেলসম্যান ছাড়াই চলছে এসব দোকানের বেচাকেনা।

‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর’। বিশ্বাসের তেমনি এক নজির সৃষ্টি করেছে এক গ্রামবাসী। কখনো কি শুনেছেন? দোকান খোলা আছে আবার বেচা বিক্রিও চলছে। তবে নেই কোনো বিক্রেতা। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়? এভাবে চললে তো দোকানদারের ব্যবসা লাটে উঠবে!

তবে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সেলিং গ্রামে এবং তার আশেপাশে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা একেবারেই ভিন্ন। সেখানে দোকানদার ছাড়াই চলে দোকান। গ্রামবাসীরা দোকান চালাতে বাড়তি শ্রম এবং সময় নষ্ট না করে।

দোকানের সামনেই স্থানীয় কৃষকরা বাঁশ ও কাঠের তৈরি টেবিলের উপর পণ্যের পসরা সাজিয়ে তার উপর মূল্য লিখে রাখা হয়। সেইসঙ্গে অর্থ পরিষোধের জন্য একটি প্লাস্টিকের বোতল বা কৌটাও রাখা হয় ।

ক্রেতাদের যার যা প্রয়োজন তা নিয়ে মূল্য সেখানেই রেখে যায়। তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের উপর পুরোপুরি বিশ্বাস এবং আস্থা আছে।

ভারতের রাজধানী থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরে একটি হাইওয়ে রাস্তার পাশেই আইজল নামে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের ছোট ছোট দোকান। যেগুলো তৈরি করা হয় কাঠ দিয়ে। তবে এই মানহীন দোকান বিশ্বে সৃষ্টি করেছে মানবতার শিক্ষা।

যাত্রীরা তাদের যা প্রয়োজন নিচ্ছে এবং নিজেরাই পণ্যগুলোর আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করছেন। পুরো বিশ্বস্ততার উপরই সেখানকার দোকান চলে। যদি পণ্য কেনার পর তা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তারও সুযোগ রয়েছে ক্রেতাদের।

এজন্য যেখান থেকে সে পণ্যটি নিয়েছিল সেখানে রেখে অন্য পণ্য নিয়ে তার মূল্যও পরিশোধ করতে হয়। এসব নিয়ম অবশ্য গ্রামবাসীর সবার সম্মতিতেই করা হয়েছে।

মিজোরামের জনগণ মিজো নামেই পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা কখনো লিঙ্গ বা শ্রেণি বৈষম্য করেনা। এমনকি তাদের একে অপরের প্রতি ঘনিষ্ঠতা নজিরবিহীন। এ কারণেই তারা ভদ্র অনেক জাতি থেকেও আলাদা। তাদের আতিথেয়তা এবং আন্তরিকতার কারণে ‘ত্লামংগাইহনা’ নামে ডাকা হয়। যার মূল অর্থ অতিথিপরায়ণ, সদয়, নিঃস্বার্থ ও সহায়ক।

এ সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজেদের মূল্যবোধের কারণেই ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেছে বলে মনে করেন সবাই। যেখানে বিশ্বাসের সাফল্যের সঙ্গে সততার আদান-প্রদান হয়। তারা যে উদ্দেশ্যে এমন দোকান করেছিলেন, তা সফল হয়েছে। স্থানীয়রাও এতে খুব খুশি। তারা জানান, গ্রাহকরা তাদের কখনোই বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। এমনকি তাদের কোনো কিছুই হারিয়ে যায়নি।

দোকানিরা সবাই কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে। তারা বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপাদন করে। দোকানে অলস বসে থাকা শুধু সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয় এমনই ভাবেন তারা। গ্রামবাসীদের একের প্রতি অন্যের বিস্তততা বর্তমান সমাজে এক নজির সৃষ্টি করেছে। এজন্যই দোকানগুলো খোলা থাকে। এ ব্যবস্থায় যেমন কারো অলস বসে থেকে সময় নষ্ট হয় না। অন্যদিকে, সবার প্রতি আস্থা অর্জনও হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

ভারতের উত্তর-পূর্ব এ রাজ্য তার উষ্ণতা এবং খোলামেলা সংস্কৃতির জন্য বেশ পরিচিত। সারা বছরই সেখানে ভ্রমণের জন্য পর্যটকরা ভিড় করে থাকেন। এছাড়াও মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, মায়ানমার এবং নেপালের আশেপাশ থেকে পালিয়ে আসা অনেকেই সেখানে বসবাস করছেন। তারাও গ্রামের নিয়ম মেনেই জীবন যাপন করছেন।

সূত্র: দ্যকালচারট্রিপ