
আট বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এই নীল চোখের শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রৌঢ়-ব্যক্তি। নাম তার রবি মায়েস্ত্রেসি। এর আগে তার জীবন কেটেছে অপরাধ-জগতের অন্ধকারে।
নতুন জীবনে তার অভিষেক কেমন ছিল, পরবর্তী কালে কোনো বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন কি না এসব নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বহু সাংস্কৃতিক ও বহুভাষিক সংবাদমাধ্যম এসবিএসডটকম.এইউর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। পাঠকদের তার সেই আলোচনার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ।



জন্ম ও বেড়ে ওঠা- আমার জন্ম ১৯৮১ সালে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। আমার যখন সাত বছর বয়স, তখন আমরা আমেরিকায় চলে যাই। তখন আমার বাবা-মা আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। বাবা তখন নুমিয়া ও নিউ ক্যালেডোনিয়ায় হোটেল-ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।
আর মায়ের আমেরিকায় কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল। আমরা ছুটিতে গিয়েছিলাম। মায়ের তখন একটি কাজ জুটেছিল। কিছুদিন পর মা পুনরায় বিয়ে করেন। আমরা নিউইয়র্ক ও নিউ জার্সিতে থাকতাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তখন টিভিতে দেখা অভিনয়ের মতো কিছু ঘটেছিল। ছোট ছেলে-মেয়েরা সবাই কেমন ক্ষি’প্ত-মা’তাল ও উন্মত্ত হয়ে যাচ্ছিল। এটি হয়তো আমার জন্য অনেক আনন্দের ছিল। তবে ‘ভুল ধরনের’ আনন্দ ছিল।



ধর্ম আমার বেড়ে ওঠার অংশ ছিল। এখনো মনে পড়ে, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মা আমাকে প্রার্থনা করতে উৎসাহ দিতেন। তিনি আমাকে গির্জায় নিয়ে যেতেন। কখনো আমরা ক্যাথলিক কোনো গির্জার কাছে যেতাম। আবার কখনো পেন্টিকোস্টালে যেতাম। তবে আমি যুবক থাকাকালীন প্রার্থনা করা বা এখানের বাইরে কিছু নিয়ে ভেবেছি এমন কথা মনে করতে পারছি না।
আমার যখন ১৬ বছর বয়স, তখন আমরা অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসি। মা তখন বলেননি আমরা আমেরিকা থেকে কেন ফিরে যাচ্ছি। তবে আমি মনে করি, ফিরে যাওয়ার কারণ ছিলাম আমি নিজেই। কেননা, ভবঘুরে হয়ে আমি যেসব ছেলেপুলের সঙ্গে চলছিলাম, সেটা আমার ভুল পথ ছিল।
একদিন মা আমাকে বললেন, আমরা ছুটি কাটাতে অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছি। কিন্তু টিকিটে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে, এটা শুধু যাওয়ার টিকিট। মা বুঝতে পেরেছিলেন, আমাকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়াই তার একমাত্র উপায়।



মন্দ-অপরাধের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া- অস্ট্রেলিয়ায় এসে কয়েক বছর আমি ঘোরাফেরা করি। আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমেরিকায় ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। না পেরে খুব বেশি হ’তা’শাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি এখানকার স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সিস্টেম ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তালিকাভুক্তির ছয় মাসের মধ্যেই আমি বাদ পড়ি।
পরে মার্কেটিংয়ের একটি কাজ পেয়েছিলাম। ঘরে ঘরে গিয়ে কাজটি করতে হতো। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্কুল ছেড়ে এ ধরনের কাজে লেগে গিয়েছিলাম। পরে একটি ব্যাংক ও সেন্টারলিঙ্কে কাজ করেছি। এই দুইটি ভালো কাজ ছিল। তবে ম’দ্য’পান আমার জীবন-পটভূমিতে সবসময় ছিল। এছাড়া সাপ্তাহিক ছুটিতে বাইরে গিয়ে আমি পার্টি করতাম।
একটি বিষয় আমি পর্যবেক্ষণ করেছি, বিনোদনের জন্য আপনি যখন ড্রা’গ নেবেন, তখন এগুলো আপনার জীবনে কিছু একটা ঘটিয়ে বসবে। পরে এগুলো বিনোদনমূলক আর থাকে না।



আমার সমস্যা ছিল যেখানে- ২২ বছর বয়সে আমি বিয়ে করি। আমি আমার বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন সারাটা সময় ড্রা’গ নিয়েছি। এমনকি যখন অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, তখনও আমি ম’দ’পান করেছি। তখন আমি পুরো নাকাল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো, আমি প্রচলিত জীবনে ব্যর্থ হয়েছি। জীবনটা ভালোভাবে উপভোগ করতে ও কাটাতে পারি না। ফলে মা’দ’ক ও অপরাধ আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এভাবে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। খারাপ, অসাধু কাজ ও অপরাধে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করতে থাকি। একসময় অপরাধ-জগতের উদাহরণ হয়ে উঠি। ড্রা’গ-সম্পৃক্ত যেকোনো কিছুতে নিজেকে জড়ানো ছিল আমার জন্য স্বাভাবিক। সুন্দর ও আনন্দের জীবন কাটানো আমার জন্য অসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। জীবন নিয়ে আমি তৃপ্ত ও খুশি হতে পারছিলাম না।
২০০৭ সালে আমি গ্রেফ’তা’র হই। মা’দ’কসংক্রান্ত অপরাধের জন্য আমাকে ১০ মাসের কা’রা’দ’ণ্ড দেওয়া হয়। সত্যি কথা বলতে, সেই সময়টা আমার জন্য খুব ভালো ছিল।



গ্রেফতারের সময় আমার শরীর- স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। কারণ আমি টানা দুই-তিন রাত জেগে থাকতাম। কখনো এর চেয়ে বেশি হতো। পার্টি-ফূর্তি ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকতাম। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতাম না। কিন্তু যখন গ্রেফ’তার হলাম, তখন ঠিক মতো খাবার ও ঘুম পেয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠতে এটি আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল।
জেল-জীবন আমার চোখ খুলে দেয়। কিন্তু যখন কা’রা’গার থেকে বের হলাম, তখন আমি সরাসরি আগের অন্ধকার জগতে ফিরে যাই। সামান্য বিরতিও নেইনি। এক মুহূর্তও আমার মনে হয়নি যে, আমি এদের সঙ্গে চলিনি। কারণ এই লোকদের সঙ্গেই ঠিক আগে আমি একই ধরনের কাজ করে এসেছি।
পুরোনো অভ্যাস পরিবর্তন- কখনো আমার মতো মানুষদের জীবনে ভিন্নতা দেখা দেয়। খারাপ কাজে আসক্ত থাকার পর আমি হঠাৎ নিজের আধ্যাত্মিক যত্ন-চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠি। নিজের ব্যক্তিত্ব ও আমার চরিত্রের প্রতি নজর দিতে শুরু করি। বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি নিজের কাছে সবচেয়ে খারাপ রূপে পরিণত হয়েছি।



আমি পুরোনো অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করতে শুরু করি। নিজের কাছে ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সৎ হয়েই এমনটা আরম্ভ করি। আমি গোল্ড কোস্টের ব্যাপটিস্ট গির্জায় যাওয়া-আসা শুরু করি। এই অঞ্চলের অভাবীদের পানাহার করানো সঙ্গে নিজেকে জড়িত করি। বৃহস্পতিবার দুপুরে খাবার রান্না করে তাদের জন্য নিয়ে যেতাম। এই জাতীয় কাজগুলো করে আমি বুঝতে পারছিলাম যে, নিজেকে পরিবর্তন করা এত কঠিন নয়। আমি চাইলে পরিবর্তন করতে পারবো।
যেসব লোক ধর্মানুরাগী এবং সৎনিষ্ঠ কাজে জড়িত তাদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করাটা আমার জন্য ভালো দিক ছিল। কেননা আমি ধর্মহীন যাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম, তারা একে অপরের প্রতি সত্যই খারাপ-মন্দ আচরণ করতো। মা’দ’কাসক্তি, মা’দ’ক বিক্রি, মা’দ’ক ও লেনদেন সংক্রান্ত কাজের জন্য একে অপরের আর্থিক এবং বিভিন্ন ক্ষতি করায় অভ্যস্ত ছিল। মূলত এটি ছিল ‘নিকষ আঁধারির মাঝে আলো হারিয়ে যাওয়া’র নামান্তর।
আমি ইশ্বরের প্রতি বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিকভাবে খ্রিস্টধর্মে আমি তৃপ্তি-সন্তুষ্টি বোধ করিনি। কিন্তু জীবনের অন্য দিকে আমি এমন ছিলাম যে, সর্বদা কোরআন পড়তে ও কোনো একটি মসজিদে যেতে চাইতাম।



একদিন আমার খুব খারাপ দিন কাটছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, কারও কাছে আমার যাওয়া দরকার। এর কয়েক সপ্তাহ আগে মুহাম্মদ নামের এক ক্যাব ড্রাইভারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তার ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি তোমার সঙ্গে মসজিদে যেতে পারি? তিনি আমাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি, ‘দেখুন, আমার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। সাহায্যও দরকার।’
সে দিন সন্ধ্যায় গাড়িতে করে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। মসজিদে গিয়ে আমি একজন ইমামের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার ভাইয়েরা সেখানে কি ভাবে প্রার্থনা করে তা দেখেছি। এটি আমার ভেতরে আলোর অনুভূতি জাগিয়ে তুলে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর আমার আত্মীয়তার আবেশ অনুভূত হচ্ছিলো।
এটি আমার পুরো জীবন বদলে দিয়েছে- আমি যে দিন কালেমা শাহাদাত পড়েছিলাম, সেই রাতে আমার সব কিছু বদলে যায়। ড্রা’গ ব্যবহারে আমার আর কোনো ইচ্ছে থাকলো না। আমার মনে হচ্ছিলো, আমি পাঁচ বছরের জন্য পরিচ্ছন্ন হয়ে গেছি। এটি আমার পুরো জীবনটাই বদলে দিয়েছে।



আমি নিজেকে রূপান্তর করার জন্য এক বছর আগে যা অর্জন করতে চেয়েছিলাম, যে উপায়-নিয়ম এবং নিজের কাছে নিজে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ার প্রচেষ্টায় ছিলাম, কালেমায়ে শাহাদাত আমাকে সেটি দিয়েছে।
ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ ও আকৃষ্টের একটি কারণ ছিল, যে মুসলিমদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তাদের ব্যক্তিত্ব ও আচরণের শক্তি। তারা কখনো ড্রা’গ ও ম’দ্য-পানীয় ব্যবহার করেনি এ বিষয়টি সত্যই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আমি যেভাবে জীবন-যাপন করছিলাম, এটি তার বিপরীত ও সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। আমার মনেও হয়েছিল, চরিত্রের এমন প্রভাব-শক্তি থাকা প্রয়োজন। একজন যুবক হিসেবে এমন প্রভাবের প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
ইসলামচর্চা ও অনুসরণের জন্য আমার পক্ষে তখন ভালো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি সব ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে একমত হয়ে বিশ্বাস করি যে, কোরআন হলো আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ। এখন বাইবেল ও এর আগের ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রতি আমার নতুন আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ আমি জেনেছি, তাতে সত্য রয়েছে। একজন ‘সুবিধাবাদী’ খ্রিস্টান হিসেবে এই গ্রন্থগুলোর প্রতি আগে আমার বিশ্বাস ছিল কিনা আমার জানা নেই।



আমি বলতে চাই, আমার জীবনের ৯৯% মানুষ আমার সমর্থক ছিলেন। কেউ ভাবতেও পারেনি যে, আমার পরিবর্তন হতে পারে। তারা আমার ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে একমত হোক বা না হোক; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তারা আমার জীবনের পরিবর্তিত রূপ দেখে নিশ্চয়ই খুশি।
ইসলামে আমি দীক্ষিত হওয়ার তিন মাস পর আমার মা ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হন। আমি জীবনে ইতিবাচক যেকোনো কাজ করেছি, আমার মা তাতে বড় সমর্থক ছিলেন। এখনও আমি যেমন বিশ্বাস করি, তিনি ঠিক তেমন বিশ্বাস করেন। আমি যেমন ইসলাম চর্চা ও অনুসরণ করি, তিনিও আমার মতোই অনুশীলন করেন।
ছয় বছর আগে আমি গোল্ড কোস্ট থেকে ব্রিসবেনে চলে আসি। স্ল্যাক ক্রিক মসজিদটি আমার স্থানীয় মসজিদ। তবে আমি হল্যান্ড পার্কের মসজিদে প্রচুর সময় ব্যয় কাটিয়েছি। সেখানে ইমামের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সব মসজিদের মতো এই মসজিদেও প্রত্যেকে একে অপরের সহযোগী ও বন্ধু-বাৎসল্য।



ভালোর সঙ্গে খারাপ- এক সময় আমাকে স’ন্ত্রা’সী বলা হয়েছিল। কিন্তু এটি আমার জন্য ‘হাঁসের পিঠে জল’র মতো। কিন্তু যদি দুর্বল ও সাধারণ কাউকে অযথা এমনটি বলা হয়, তাহলে আমার রাগ লাগে। যদি আমার ব্যাপারে বলা হয়, অসঙ্গত হলেও মেনে নেওয়া যায়। কারণ আমি নীল চোখের একজন অস্ট্রেলিয়ান। শরীরে ক্রস-ট্যাটু ইত্যাদির কারণে ভিন্ন রকম লাগতে পারে।
জীবনে প্রথমবার যখন আমার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তখন ভিন্ন রকম একটি অনুভূতি কাজ করে। এটি অদ্ভুত রকমের অনুভূতি যে, কেউ আপনাকে ঘৃণা করবে আপনার কোনো কাজ কিংবা অন্য কিছুর কারণে নয়; বরং আপনার বিশ্বাসের কারণে। অথচ তারা আপনাকে না জেনে আপনার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।
এখন আমি কমিউনিটির প্রচার-উন্নয়নে কাজ করি। আমি এমন লোকদের খোঁজ করি, যাদের প্রতি সহায়তা করা জরুরি। ‘আপনার যদি কিছু দরকার হয়, তবে আমাদের খবর দিন’ কথার বিপরীতে সরাসরি নিজে খোঁজ নিয়ে সহায়তা করাই আমার কাছে মূল্যবান। বাইরে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে এবং আমার কাজ সম্পর্কে জানাতে ও সহায়তা দিতে আমার সুখ লাগে।