
খাদ্যের খোঁজে মানুষের কাছে হাত পাতা – খোলা আকাশ, কিন্তু আকাশের নিচে তাঁদের ঘর-বাড়ি নেই, রাতে নেই ঘুমানোর জায়গা। দিনের বেলা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। এক কাপড়ে মাস কেটে যায়। কখনো ফুটপাতে, কখনো বাজারে কিংবা রাস্তার মোড়ের চত্বরে তাদের বসবাস।



যেখানেই রাত, সেখানেই কাত অবস্থা। ঘুম থেকে উঠে খাদ্যের খোঁজে মানুষের কাছে হাত পাতা। কেউ তাঁদের সাহায্য করছেন, কেউ বা করছেন না। করোনা ভা’ইরাস আ’ত’ঙ্কে’র এই দিনগুলোতে এ ভাবেই স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে দিন কাটছে মো. কিতাব আলীর।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ের সার্ক ফোয়ারার চত্বরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে দেখা যায় কিতাব আলীকে। সঙ্গে দেখা যায় তাঁর স্ত্রী লিপি (২৬), ছেলে মো. শুকুর আলী (১২) ও মেয়ে শান্তা মনিকে (৮)।



লিপি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সে জন্য তেমন কাজ করতে পারেন না তিনি। এ দিকে এক দুর্ঘটনায় ভেঙে গেছে কিতাব আলীর বুকের হাড়। ভারি কাজ করতে পারেন না তিনি। তবে হালকা কাজ করে পরিবার সামলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ঠিকমতো সংসার চলে না।
তাই কাজ শেষে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে সংসার চালান তিনি। সঙ্গে হাত পাতে তাঁর দুই সন্তানও। কথাগুলো জানাচ্ছিলেন কিতাব আলী নিজেই।
সারা বিশ্ব তোলপাড় করে ফেলা করোনা ভা’ইরাসের কারণে অনেক দিন ধরে ফাঁকা রাজধানী ঢাকা। পরিবেশ তৈরি হলো। সব স্থবির হয়ে যায় পুরো শহর।



দেশে অঘোষিত লকডাউন অবস্থা জারি হয়। আর তাই এই ফাঁকা ঢাকায় এখন কোনো কাজ করতে পারছেন না কিতাব আলী। ১০ দিন আগেও কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করে সন্তানদের ভাত খাইয়েছেন তিনি। কিন্তু এখন সব বন্ধ, খেয়ে চলার মতো তাঁর হাতে নেই কোনো অর্থ।
এই যখন অবস্থা, তখন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রাস্তা দিয়ে চলাচল করা মানুষের কাছে হাত পাতছে কিতাবের ছেলে-মেয়েরা। ফোয়ারার কাছে একটি গাড়ি থামা মাত্রই ছুটে যায় কিতাব আলীর ছেলে শুকুর আলী ও মেয়ে শান্তা মনি।



চালকের আসনে বসে থাকা সাগর হোসেন গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ২০ টাকার দুটি পাউরুটির প্যাকেট দিলেন। পাউরুটি নিয়ে সেকি আনন্দ শিশু দুটির! সঙ্গে সঙ্গে একটি পাউরুটির প্যাকেট ছিঁড়ে মা-বাবাসহ ক্ষুধার জ্বালা মেটায় তারা। আর একটি পাউরুটি রেখে দেয় পরবর্তী সময়ের জন্য।
এর কিছুক্ষণ পরই অচেনা এক ব্যক্তি গিয়ে শান্তা মনিকে ২০ টাকা দেন। টাকা পেয়েই শান্তা তখন বলতে থাকে, ‘আব্বা এই রুটিটা দুধ-চা দিয়ে খাব।’ কিতাব মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। চত্বরে বসেই কিতাবের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। চার বছর আগে কিতাব মিরপুরের হযরত শাহ আলী (রহ.) মাজারে রাঁধুনির কাজ করতেন।



কিন্তু দু’র্ঘ’ট’না’য় বুকের হাড় ভেঙে যাওয়ায় আর রাঁধুনির কাজ করতে পারেননি তিনি। গল্পে গল্পে কিতাব আলী বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষ সব গ্রামে গেছে। কাজ কাম পাইতাছি না। ছেলে-মেয়ে দুইটা খিদিতে (ক্ষুধায়) ছটফট করে, তাই হাত পাতি। অনেকে সাহায্য করে, অনেকেই করে না।
করোনার কারণে ভ’য় লাগছে। আমি করোনায় মইর্যা গেলে আমার বাচ্চা দুডোরে কে দেখবে? আমার বউর পেটে বাচ্চা। খুব ভয় কচ্ছে রাস্তায়। কিন্তু আমরা কোথায় থাকব? আমাদের ঘর নাই। রাস্তা ছাড়া কোনো পথ নাই। সেই ছোটবেলা থেকে রাস্তায় রাস্তায় থাহি মামা।’



কিতাব আরো বলেন, ‘বুধবার রাতে একজন আমাগোর চারজনকে চার প্যাকেট খিচুড়ি দিছিল। রাতে দুই প্যাকেট চারজনে খাইছিলাম। আর সকালে দুই প্যাকেট খাইছি। দুপুরে ৩০ টাকার ভাত কিনে খাইছি চারজন। আর ২০ টাকার দরকার। রাতে কিনে খাওয়ার কিছু নাই। কেউ দিলে খাব, না দিলে আল্লাহ আছেন উপরে। এনটিভির ভবনের নিচে গিয়ে বসব আরেকটু পর।
ওখানে রাতে খিচুড়ি দেয় বড় স্যারেরা। কারওয়ান বাজারের চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে টিভি দেখি। ঘরে থাকতে কয় সব সময়। আমার তো ঘরই নাই। করোনায় মরলে এই রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে। হাসপাতালেও কেউ নিবে না। সরকার বারবার ঘরে থাকতে বলে। আমার ঘর নাই। রাস্তায় না থাকলে, মানুষে না দিলে খাব কী ? বলছিলেন কিতাব।



কিতাবের স্ত্রী লিপি বলেন, ‘আমরা আগে ভালোই আছিলাম। এখন খুব খাবার কষ্ট। আমার পেটে বাচ্চা, ওষুধও কিনতি পাচ্ছি না। এদিকে ভাইরাসের চিন্তা। আমার দুই বাচ্চার জন্য চিন্তা হয়।’
কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনের নিচের ফুটপাতে ত্রাণের আশায় বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে লাইন ধরে অন্তত ২০ জন বসে ছিলেন। তাঁদের একজন মো. খলিল (৬৩)। ওই স্থানেই গত ১২ বছর ধরে তিনি ঘুমান। খলিল বলছিলেন, ‘রাতে এসে লোকজন খিচুড়ি, না হয় বিরিয়ানি দেয়। তাই খেয়ে থাকি। এখন আর কাজ করতে পারি না। চেয়ে-চিন্তে চলি। পাঁচদিন আগে একজন চার কেজি চাল আর বিরিয়ানি দিয়েছিল।



গত চারদিন শুধু রাতে খিচুড়ি দেয়। মাসোক (মাস্ক) কেনার টাকা ছিল না। পুলিশে রাস্তায় বকাবকি করে, তাই কিনছি। অন্য বছর শবে বরাতের এই রাতে হালুয়া-রুটি আর টাকায় ভরে যেত। অনেক লোকে দিত। আজ কেউ টাকাও দিল না। রুটি তো চোখেই দেখলাম না। খলিলের পাশে বসে থাকা কুদ্দুস আলীর কাছে হোম কোয়ারেন্টিন মানে বোঝেন কি না জানতে চাইলে বলেন, সে আবার কী ? জীবনে আইজকা প্রথম শুনলাম।
বুঝিয়ে বলার পর কুদ্দুস বলেন, আমার ঘর নেই। কার ঘরে থাকব ? কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। আমরা রাস্তার মানুষ। মরে গেলেও কেউ দেখবে না।