
বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া যাবে না যার কখনো সাধারণ সর্দিজ্বর হয়নি। সর্দিজ্বর একটি ভাইরাসজনিত ছোঁয়াচে রোগ। ছোট শিশু থেকে শুরু করে সবাই এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দিজ্বর হওয়া খুবই সাধারণ একটি বিষয়। খুব সামান্য কারণে সর্দিজ্বর মানুষকে ভোগাতে পারে, আবার সহজে সেরেও যেতে পারে। এই রোগের উপসর্গ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে একই রকম।



সর্দিজ্বর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হওয়া রোগগুলোর একটি। চিকিৎসকের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বছরে ৪ থেকে ৬ বার এবং একটি শিশুর বছরে ১০ থেকে ১২ বার সর্দিজ্বর হওয়া স্বাভাবিক। একজন মানুষের জীবদ্দশায় ২০০ বারের বেশি সর্দি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কারণ ও কিভাবে ছড়ায়
অনেক ভাইরাস এই রোগের কারণ, রাইনো ভাইরাস প্রধান কারণ। Rhinovirus এর ১০০ এর বেশি সেরোটাইপ আছে। বায়ুবাহিত ছোটছোট কনার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায় এবং মুখ, নাক, চোখ ইত্যাদি পথে শরীরে প্রবেশ করে।



রোগীর কাশি, সর্দি বা ব্যথার মাধ্যমে ভাইরাস বাতাসের সংস্পর্শে আসে এবং স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে। শরত্ ও বসন্তকাল এইরোগ বেশী হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ঋতু পরিবর্তনের সময়টায় এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।
এক সময় ধারণা করা হতো একটি বিশেষ গোত্রের ভাইরাসের মাধ্যমেই শুধু সর্দি হয়। তবে ৮০’র দশকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয় যে, মোট সাতটি গোত্রের ভাইরাসের কারণে সর্দিজ্বর হয়ে থাকে। ঠাণ্ডা মৌসুমে বা শীতের সময় এই ভাইরাসগুলো দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার মত পরিবেশ পায় বলে শীতে সর্দি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়।



সর্দিজ্বর সংক্রমিত থাকা অবস্থায় নাসারন্ধ্রের ভেতরে মিউকাস লাইনিং অতিক্রম করে প্রবেশ করে সংক্রমণকারী জীবাণু। এর ফলে নাসারন্ধ্রের ভেতর অতিরিক্ত সর্দি জমা হয়। যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় ‘রাইনোরেয়া’।
ঠাণ্ডা বা সর্দি থেকে দ্রুত উপশম লাভ করার উপায়-
খুব সামান্য কারণেই ঠান্ডা বা সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হতে পারে যে কেউ। সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যেই মানুষের সর্দিজ্বর ভালও হয়ে যায়। তবে কয়েকটি উপায়ে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত সময়ে সর্দিজ্বর ভাল করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এবার সে উপায়গুলো জেনে নিন-



ঘুম বা বিশ্রাম :
ঘুম মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কাজেই ঠাণ্ডা বা সর্দিজ্বরের সময় বিশ্রাম নিলে বা বেশি ঘুমালে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।
উষ্ণ পরিবেশে থাকা :
সর্দিজ্বরের সময় উষ্ণ পরিবেশে থাকা বা উষ্ণ পোশাক পড়ে থাকলে এই রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
প্রচুর পরিমাণ তরল পানীয় গ্রহণ করা :
প্রচুর পরিমাণে পানি বা ফলের রস পানের মাধ্যমে পানিশূন্যতা রোধ করলে ঠাণ্ডা থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যেতে পারে।



গলার যত্ন নিন :
ঠাণ্ডার একটি সাধারণ উপসর্গ গলা ব্যাথা। লবণ পানি দিয়ে গার্গল করা অথবা লেবু এবং মধু দিয়ে হালকা গরম পানীয় তৈরি করে পান করলে গলা ব্যাথা দ্রুত উপশম হতে পারে।
সতর্কতামূলক পদক্ষেপ :
সর্দি যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কেননা সর্দি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেও অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে যা করবেন- গরম পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, ঠাণ্ডায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে তোয়ালে বা গৃহস্থালির দ্রব্যাদি (যেমন কাপ, প্লেট) শেয়ার না করা, ঠাণ্ডা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর নিজের চোখ বা নাক স্পর্শ না করা।



যেভাবে সর্দিজ্বর থেকে নিজেকে বাঁচাবেন-
মিষ্টি আলু, বিটের মূল, কুমড়ায় প্রচুর পরিমাণ বেটা-ক্যারোটিন থাকে। এই বেটা-ক্যারোটিনকে আমাদের দেহ ভিটামিন এ’তে রূপান্তরিত করে। ভিটামিন এ আমাদের নাক এবং ফুসফুসের মিউকোসাল লাইনিংকে শক্ত রাখে যা নাগ ও ফুসফুসকে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচায়। তাই এগুলো বেশি পরিমাণে সবারই খাওয়া উচিত।
পাশাপাশি কমলা, আম, তরমুজসহ লাল ফল একই ধরনের কাজ করে। তাই এগুলোকেও খাওয়া থেকে বাদ দিবেন না।
খাবারে যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ ও রসুন থাকলেও ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। পেঁয়াজ ও রসুনে একধরনের তেল থাকে যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। তাই পেঁয়াজ ও রসুন সমৃদ্ধ খাবার খাবেন।



ঠাণ্ডা বা সর্দিজ্বর থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে ভিটামিন সি’র ভূমিকা অনেক আগে থেকেই প্রমাণিত। তাই উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি গ্রহণ করে সর্দিজ্বর বা ঠাণ্ডার হাত থেকে নিজেকে বাঁচান।
সূর্যের আলো বা অন্য কোনো উৎসের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি গ্রহণও শরীরকে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।
চিকিৎসকরা বলেন, টানা সাতদিনের বেশি সর্দিজ্বর থাকলে বা টানা তিনদিনের বেশি সর্দির সঙ্গে উচ্চমাত্রায় জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শিশুদের ক্ষেত্রে সাতদিন অপেক্ষা না করে, তিনদিনের বেশি সর্দি থাকলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
শেষ কথা
মানুষের জীবনকাল সীমিত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। দৈহিক ও মানসিক সূস্থতার জন্য কমন কোল্ড-এর মত সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ও চিকিত্সার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এই রোগ থেকে মুক্তির পরও জীবণ যাত্রার ধারাবাহিক পরিবর্তণ চালিয়ে যেতে হবে। আদর্শ জীবনযাপণের বিকল্প কিছু নেই।