হাত-পা নেই, মুখ দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ পেল ‘লিতুন’ !

1812

দুই হাত-পা ছাড়াই জন্ম নেয়া লিতুন জিরা মুখে ভর দিয়ে লিখেই এবার পিইসি পরীক্ষা দিয়েছিলো। আর মুখ দিয়ে লিখেই জিপিএ-৫ পেলো অদম্য মেধাবী লিতুন জিরা। লিতুন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শেখপাড়া খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে। সে এবার উপজেলার খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিইসি পরীক্ষায় অংশ নেয়।

লিতুন জিরার বাবা হাবিবুর রহমান ও মা জাহানারা বেগম জানান, দুই হাত ও পা ছাড়াই লিতুন জিরা জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতেন তারা। এখন মেয়ের মেধা তাদের আশার সঞ্চার করছে। লিতুন জিরা আর দশজন শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া-দাওয়া, গোসল সব কিছুই করতে পারে। মুখ দিয়েই লিখে সে। তার চমৎকার হাতের লেখা যে কারও দৃষ্টি কাড়বে। এসময় কথা হয় তার সঙ্গে।

লিতুনের একটাই ইচ্ছা, পরনির্ভর না হয়ে লেখাপড়া শিখে নিজেই কিছু করতে চায় সে। তবে কিছুদিন আগে মা”রা যাওয়া দাদুর জন্য খুব মন খারাপ লিতুন জিরার। দাদু বেঁচে থাকলে তিনি খুব খুশি হতেন বলে জানালো লিতুন জিরা।

স্থানীয়রা জানায়, লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহী লিতুন জিরা প্রখর মেধাবী। হুইল চেয়ারেই বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে এ-প্লাস পেয়ে মেধার সাক্ষর রেখেছে। তার বাবা উপজেলার এ. আর মহিলা কলেজের প্রভাষক। তিনি ১৭ বছর ধরে ওই কলেজে চাকরি করলেও আজও কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়নি। তার বাবাই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু বেতন না পাওয়ায় খুব কষ্টে তাদের সংসার চলে।

লিতুন জিরার প্রধান শিক্ষক সাজেদা খাতুন বলেন, তার ২৯ বছর শিক্ষকতা জীবনে লিতুন জিরার মতো মেধাবী শিক্ষার্থীর দেখা পাননি। এক কথায় সে অসম্ভব মেধাবী। শুধু লেখাপড়ায় না, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অন্যদের থেকে অনেক ভালো।

সারাদিন চায়ের দোকানে কাজ, রাতে পড়াশুনা করে জিপিএ-৫

মো. বিশাল মিয়া পিইসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার সাহেরা গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিশাল। বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে দিন কাটিয়ে গভীর রাতের পড়াশুনায় তার এ সাফল্য।

বিশালকে কাজে পাঠানো হয়েছে জানালেন তার বাবা। মাথায় চিনি ও হাতে চা পাতার প্যাকেট দেখে বোঝার বাকি রইলো না এটাই বিশাল। পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে কেমন লাগছে? কাছে আসার পর এমন কথায় মুচকি হাসলো। চিনি, চাপাতা থেকে তার সাথে চলে খোশ গল্প।

ভালো ফলাফলের কথা জেনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যাওয়ার হয় বিশালদের চায়ের দোকানে। দোকান বলতে ভ্রাম্যমাণ চা স্টল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের দুই নং ফ্ল্যাটফরমের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে তাদের দোকানটির অবস্থান।

সন্ধ্যার পর দোকানটিতে ক্রেতার আনাগোনা বেশ থাকে। চা বানাতে বানাতেই কথা বললেন বিশালের বাবা মো. লিয়াকত মিয়া। জানালেন, গ্রামের বাড়ির জে’লার আশুগঞ্জ উপজে’লার আড়াইসিধা গ্রামে। থাকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার মৌড়াইলে।

স্ত্রী’, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সংসার। বাড়ি ভাড়া, তিন সন্তানের পড়াশুনার খরচসহ অন্যান্য সাংসারিক ব্যয় মেটানো হয় চা বিক্রির আয় থেকেই। আগে বড় ছেলে ইভান দোকানে থাকতেন। কয়েক বছর ধরেই সঙ্গে থাকে বিশাল। বিকেল পাঁচটার পর এসে বাড়ি ফিরে রাত একটার দিকে। এরপর পড়তে বসে। ডিপ্লোমায় পড়াশুনা করা ছেলে ইভানও আগে এভাবে দোকানে বসতো।

কথা হয় বিশালের সঙ্গে। জানায়, স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট শিক্ষক আমেনা আক্তার তানজিনার কাছে পড়তো। এ ছাড়া দোকান থেকে বাড়ি ফিরেও পড়াশুনা করতো। মা কুলসুম বেগম তাকে স্কুল পাঠানো, পড়াশুনা নিয়মিত করার বিষয়ে উৎসাহ দেয়। বড় ভাই, বোনদের কাছ থেকেও উৎসাহ পায়।

বিশালের পিইসির ফলাফল বিবরণী থেকে দেখা যায়, সে ছয়টি বিষয়ের প্রতিটিতেই এ প্লাস পেয়েছে। বাংলায় ৮৫, ইংরেজিতে ৮৭, গণিতে ৮০, সমাজ বিজ্ঞানে ৯০, সাধারন বিজ্ঞানে ৯১ ও ধ’র্মে ৯৬ নম্বর।

রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় তার পরিচিত নাম বিশাল। অনেকেই তার এ সাফল্যে অ’বাক হয়েছে। আগে থেকে জানা থাকা কেউ আবার তাকে পুরস্কার দিবেও বলেছেন। এ প্রতিবেদককের কাছে বিশালের ফলাফল জেনে অনেকেই দোয়া করেন।

কথা হয়, পৌর এলাকার মেড্ডার সাঈদ সালমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আম’রা কয়েকজন প্রতিদিন সন্ধ্যায় লিয়াকত মিয়ার দোকানে চা খাই। বিশালকে আগে থেকেই চিনি। কিন্তু সে যে পড়াশুনায় এতো ভালো তা জেনে অ’বাকই হলাম।’

দাতিয়ারার বাসিন্দা কাজী মো. রেজাউল করিম বেশ উচ্চস্বরেই জানতে চায়, বিশাল তোর রেজাল্টা কি। জিপিএ-৫ পাওয়ার কথা শুনেই তিনি বিশালের জন্য পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে বিশালের রোল নম্বর যে এক ছিলো তা জানতেন।

বিশালের প্রাইভেট শিক্ষক এসএসসি পরীক্ষার্থী আমেনা আক্তার তানজিনা জানান, পড়াশুনার প্রতি বেশ আগ্রহ ওর। শি’শু শ্রেণি থেকেই আমি তাকে পড়াশুনা করাই। পরীক্ষা চলাকালীনও রাতে একটা-দুইটা পর্যন্ত দোকানে ছিলো বিশাল।

বিশাল পড়াশুনার পাশাপাশি ভালো ক্রিকেটও খেলে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ তার পছন্দের খেলোয়াড়। সেও একজন অলরাউন্ডার হতে চায়। তবে বড় কোনো জায়গায় এখনো খেলার সুযোগ হয়নি। পড়াশুনা শেষ করে সে প্রকৌশলী হতে চায়।

কথা হয় বিশালের সহপাঠি শরীফের সঙ্গে। হাসোজ্জল মুখে শরীফ জানায়, বিশাল খুব ভালো ছেলে। সে অনেক পরিশ্রম করে। দোকানে সময় দিয়ে রাতে সে বাসায় গিয়ে পড়াশুনা করে। তার ভালো ফলাফলে সেও বেশ খুশি। জিপিএ-৫ পাওয়া শরীফ জানায়, তার বাবা অটো রিকশার চালক।